ফেলুদাকে আমার পোষায়না। ফেলুদার গল্প পড়তে যে ভয়ানক খারাপ লাগে তা না, এক-আধটা ভালোই, কিন্তু ফেলুদাকে জাস্ট নেয়া যায়না। ছোটবেলায় এটা আমার খুব চাপ লাগত। এই যে সক্কলে ফেলুদার এতো ফ্যান। ছোট-বড় মিলে এত এঞ্জয় করে। আর আমার পড়লেই বিরক্ত লাগে। আমি কি পাগল নাকি! সেই দশের সমস্যা আজ চল্লিশেও রয়ে গেছে। ফেলুদার পপুলারিটি আর আমার বিরক্তি কোনটাই বদলায়নি। তাই ভাবলাম লিখেই ফেলি। আর মার খাবার তো ভয় নেই, বঙ্গজন সুধী, পছন্দ না হলে হয় ভ্রুকুটি নয় চার অক্ষর।
শুরুর আগের কথা। ফেলুদা সাহিত্যের ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই। ওরম ঝকঝকে আনন্দবাজারের ভাষা কমই পড়েছি। আমার চেষ্টা শুধু ফেলুদার চরিত্রহননের।
ফেলুদা প্রচন্ড প্রিভিলেজেড, প্রচন্ড পাকা, আর গা গুলোনো মধ্যবিত্ত, এক কথায় বালিগঞ্জ। আরো চাপের হল ফেলুদার প্রিচিং।
এটা নিশ্চই আপনাদের বলতে হবেনা যে বেহালা, বালিগঞ্জ, খিদিরপুর এগুলো সব properties। সহজেই টেস্ট করা যায়। যেমন ধরুন ক্যালেন্ডার টেস্ট। কোন বাড়ি বেহালা কি বালিগঞ্জ জানতে হলে খুঁজুন মা কালী-র ক্যালেন্ডার, পেলে বেহালা, না পেলে হতেও পারে বালিগঞ্জ। নেক্সট টেস্ট, খুঁজুন রবিগুরুর পোর্ট্রেট কি বাস্ট, নো মা কালী আর ইয়েস রবিগুরু, শিওর বালিগঞ্জ। বাকি attribute গুলো এমনি বসিয়ে নেওয়া যায়, পাঠভবন, সুমন, তন্তুজ, মানিকদা, জর্জদা, ফেলুদা, টিনটিন, গ্লেন ফিডিচ, শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা। বেহালার বাড়িতে এর আদ্ধেক কথার মানেও কেউ জানেনা।
ফেলুদা পুরুষ, লম্বা, ফরসা, সুদর্শন, সুগঠন, উচ্চবর্ণ, উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত। দায়িত্ব নেই কোনরকম (এটা অবশ্য পুরুষমাত্রেই)। এমন কি ফেলুদা যে অনাথ, সেটাও অলমোস্ট ওর প্রিভিলেজ। কাকা কাকিমা (কাকিমাটা বোধহয় সিনেমার থেকে ভাবছি, বইতে আছে? ) যে শুধু দামড়া বয়েস অব্দি পোষেন তা নয়, তারা পুরোপুরি in awe! সত্যি বলতে যে কেউ ফেলুদাকে দেখলেই in awe, প্রিভিলেজ চমকায় নিশ্চই চোখেমুখে, নইলে কেন। এবার বঙ্গদেশে যে কটা অনাথ বাচ্চা, এমন কি যে কটা বাচ্চাবুড়ো, তাদের মধ্যে সুবিধের লিস্টে ফেলুদার স্থান কিরম ভাবুন একবার। একি গল্প বাবার ক্ষেত্রেও (ফেলুদার কি মা আছে?), কোন অঙ্কের মাস্টারের এমন দাপট থাকে। কজনের ভাই ভাইয়ের বউ তার ছেলেকে এত তেল দিয়ে পোষে? রেয়ারেস্ট অফ রেয়ার। ফলটাও তেমনি, এই পরিমান সুবিধে পেয়ে যে ফেলুদা মোটামুটি বড়লোকের খিদ্মত্গারি করে দিন কাটান আর ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার আর ম্যাগনাম সেন্টের গন্ধবিচার করে বাহবা পান, এতে অবাক কি আর। আম্বানির ছেলে হলে, রোগা হওয়াই জীবনের শ্রেষ্ঠ চ্যালেঞ্জ।
পাকামোর দুটো উদাহরণ দেব, বাকি আপনার দায়িত্ব। এক, প্রদোষ সি মিটার। সিরিয়াসলি? মানে আংরেZ চলে গ্যয়ে ভাই, অনেক দিন। আপনার বাবা না স্বাধীনতা সংগ্রামী? মিত্রকে কেউ মিটার বলেনা, পাগলেও না। ফেলুদার ৩০-৪০ বছর আগে শিব্রাম বরং উল্টো বলে গেছেন, অমর গল্প “গ্যাস মিত্রের গ্যাস দেওয়া” তে। দুই, কোন গল্প মনে নেই, লালমোহনবাবু ঢুকতেই ফেলুদা শুরু, আপনি এই খেলার এই গ্যালেরির এই কোনে বসেছেন, দুবার বগলে হাত বুলিয়েছেন, আপনার পাশের লোকটা গুটকা খায় আর কানে বিড়ি রাখে, মুসলমান, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সকলে হৈহৈ, "হরি হরি, কি খেল দেখালে গুরু।” কিন্তু কেন? মানে এই এতগুলো ইন্ফরমেশন ইন্ফার বা ডিডিউস করে (যার নব্বইভাগের হাজারটা অন্য মানে হতে পারে) লাভটা কি হল? লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত তো সব। এত কেরদানির দরকার হতনা। কিন্তু কেরদানি না দেখালে ফেলুদার চলবে কেন? আর তো কাজ নেই। যেসব পাকা বাচ্চা বাড়িতে কেউ এলে আবৃত্তি করে শোনায় তার থেকে তফাত নেই কিছু। বাচ্চাগুলো উনতিরিশে এরম করবে না আশা (আমার ছোটবেলায় অবিশ্যি আফ্রিকা পদ্য পড়া কাকুরাও ছিল)। ফেলুদার থেকে রেহাই নেই।
প্রসঙ্গত, সিধুজ্যাঠার কথাও ভাবুন। একটা খিটকেল বুড়ো, কাগজ কেটে জমায়, তাও খুনখারাপি রাহাজানির খবর। কি আজব। আপনি আমি হলে পাগলাগারদ, সিধুজ্যাঠা দেবতূল্য। কত পয়সা? খাওয়ায় কে? চাকর বাকর কটা? আর জ্যাঠামোর কথা তো বাদই দিলাম। ফেলুকেও পরীক্ষা দিতে হয়, কে কবে কার ফিঙ্গারপ্রিন্ট, যত ভুলভাল।
কিরম মধ্যবিত্ত? একটাই উদাহরন দেব। ফেলুদার চেহারাটা ভাবুন, ছফিট লম্বা, যোগব্যায়াম করা, ১৫ মিনিটে জুডো কি হক্কাইদো শিক্ষা, মারপিট থেকে হ্যান্ডস্ট্যান্ড সবেতেই তুখোড়। সেই লোকটা ক্রিকেটে কি করে? স্লো অফ ব্রেক। হা ইশ্বর।
এবার শেষের কথা, ফেলুদার প্রিচিং। আগে ফেলুদা কি নিয়ে কথা বলেনা সেটা দেখি, ফেলুদা গরিব লোকের কথা বলেননা (সোনার কেল্লা বলবেন তো? খালি নামটা দেখুন), মেয়েদের কথা তো নয়ই। ফেলুদার আশ্চর্য বুদ্ধিতে সার্কাসের রোম্যান্টিসিজ্ম ধরা পড়ে, জন্তু-জানোয়ারের কষ্ট, কদাচ না। এদিকে এক্সেন্ট্রিক বড়লোক, ফেলুদার প্রিয় চরিত্র। কি নিয়ে বলেন? অবান্তর বাজে ফান্ডা, যেমন ধরুন অধিকাংশ লোক নাকি ১ থেকে ৫ এর মধ্যে সংখ্যা বললে বলে ৩, ১০ এর মধ্যে হলে ৭, আর ফুল গোলাপ। বিবিসির কফি রিসার্চও (যার থেকে আজ জানা যায় কফি খেলে মনোবল বাড়ে। কাল জানা যায়, আসলে মনোবল না, চুলকুনি বাড়ে মাত্র।), এর থেকে scientific। কিন্তু ফেলুদা কি বাণী দেন তাই নিয়ে আমার চিন্তা নেই, কিভাবে সেটা নেওয়া হয় তাই নিয়ে অসুবিধে। ধরুন এই যে তোপসে, স্বেন হেদিন থেকে বেগম আখতার পর্যন্ত সব ব্যাপারে ফেলুদার বক্তব্যকে যে আপ্তবাক্য বলে মেনে নেয়, এটা কি ভালো কথা? এই যে কোন প্রশ্ন না করা। ফেলুদা, এবং সেই সূত্রে বালিগঞ্জ আর যতরকম হাফ ইংরেজ ঢ্যামনামোতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, তোপসে কি কোনদিন ভাববে সার্কাসের জন্তুরা কিরম অত্যাচারিত। কি আমরা মেয়েদের সাথে কেমন ব্যবহার করি? ফেলুদার শ্রেষ্ঠত্বের স্বতসিদ্ধতা আর তার সুবাদে ফেলুদার কোন কথা বা কাজের বিরুদ্ধতা যে অভাবনীয়, এবং তারই করোলারি হিসেবে যে আমাদের সকলের বালিগঞ্জের আভিজাত্যের জয়জয়কার করা উচিত, এই দাবিটা ফেলুদায় বড্ড।
রিডেম্পশন? আমার পাঠে লালমোহন বাবুর প্রতি শ্রদ্ধা, দেশি আর্টের প্রতি দরদ, আর সুকুমার রায়।
শেষের গল্প। ছোটবেলায় বাড়িতে খুব চাপ ছিল, তাই বাইরে বাইরে বেড়াতাম। ক্লাবরুমে টিভিতে খেলা দেখাচ্ছে, ১৯৯১/৯২ ক্রিকেট ওয়ার্ল্ডকাপ, ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া। কে একটা ববির কথা বলায় এক মাতব্বর ক্লাবসদস্য বললেন, “আরে ববি রবসন (১৯৯০ এর ফুটবল ওয়ার্ল্ডকাপ মনে করুন), কি ভালো কোচ।” আমি ফস করে “ওটা রবসন না, সিম্পসন, ববি সিম্পসন।” কি ভাবছেন? সবাই বাহ বাহ বলল? না। আমার পাকামো অচিরেই শাস্তি পেল। খেলা আর দেখা হল না। ইন্ডিয়া ১ রানে হারল। গুনে দেখলাম, এক পুংলিঙ্গ ছাড়া বাকিগুলো সবই “না” (বেঁটে মোটা কালো গরীব), আমার ভাগ্যে। প্রিভিলেজ speaks, বাকিদের চুপ থাকাই ভাল।