Friday, September 1, 2023

ভদ্দরলোকের কৃষ্টি

তাসের দেশ গপ্পোটা মূলত কলোনিয়াল। বাঁধ ভাঙ্গা আর গান শোনার উৎসাহে সেটা প্রায় চোখেই পড়েনি এদ্দিন। সেদিন হঠাত শুনতে গিয়ে মনে হল, এটার একটা পোস্টকলোনিয়াল পাঠ করাই যায়। তাই লেখা। 

বলে রাখা ভাল, ছোটবেলা থেকে তাসের দেশ (HMV) আমি অনেকবার শুনেছি, একবার অভিনয় দেখেছি, কিন্তু পড়িনি কখনো। কদিন আগে নেট থেকে পড়লাম একটা প্রথম সংস্করণ (১৯৩৩), আরেকটা স্বরবিতান (১৯৩৯) থেকে। খানিক আলাদা সবকটাই। আমার ভাবনাগুলো সবি শোনা থেকে, কিন্তু বক্তব্যটা শুধু লেখা নিয়ে।


/ কেন কলোনিয়াল


রাজপুত্রের দেশটা যা কোথায়, নিয়ে সন্দেহ থাকলেও নিয়মনিগড় জাতপাতে বাঁধা গুরুমশাই-এর তাসের দেশটা যে আমাদের তা নিঃসন্দেহ। আমরা বাদামি, রাজপুত্রকে হাল্কা সাদা ধরলে, গল্পটা এক কথায় গায়ত্রী স্পিভাকের “white men saving brown women from brown men” অর্থাৎ সতীদাহ প্রথা রদ নিয়ে স্পিভাকের পোস্ট-কলোনিয়াল ব্যাখ্যা, এখানে verbatim বসে। 


একেবারে first principle থেকে দেখতে গেলে, কলোনিয়াল দৃষ্টির মূল হল

১/ আগন্তুকরা নেটিভদের থেকে আলাদা এবং শ্রেয়। 

২/ তাদের এই ভিন্নত্ব এবং ভালোত্ব প্রশ্নাতীত এবং অনতিগম্য। 


দুপক্ষই, অর্থাৎ (ভালো) নেটিভরা আর উপকারী আগন্তুকরা, সেটা জানে আর মানে। সব কালো লোক সাদা হলে (বা চাঁড়ালগুলো বামুন হলে) যে পৃথিবীতে অশান্তি কমত এতো আমরা সবাই মানি। সাদা হওয়া শিখে নিলেই হয়। অথচ কালোরা কিছুতেই সাদা হয়ে ওঠেনা, বড়জোর সিডনি পয়েটিয়ার হয়। 


এই ভাবনা তাসের দেশ-এর ছত্রে ছত্রে। তাসের তুলনায় মানুষরা এতই ভালো যে তাই নিয়ে প্রশ্ন নিরর্থক। তাসের সাথে মানুষের (রাজপুত্র-সদাগর) সম্পর্ক সম্পূর্ণ একমুখী। মানুষ ত্রাণকর্তা, তাসেরা মানুষের হাত ধরে মুক্তি (মুক্ত, শুদ্ধ, পূর্ণ কত কি) পাবে। উলটো কিছু যে হতে পারে, অর্থাৎ মানুষ যে তাসদের থেকে কিছু জানতে, শিখতে পারে, এমন কোন সম্ভাবনাই নেই। 


এদিকে মানুষের চোখে মানুষ যে তাসেরা হবেনা, সেটাও মোটামুটি স্পষ্ট। তবে তারা কি হবে? তাসিনিদের কথায় শুনি,


দহলানীগাছের আড়াল থেকে কাল শুনলুম, সদাগরের পুত্তুর বলছিল, এরা যে মানুষের সং সাজছে। 

টেক্কানী: ওমা, কি লজ্জা। রাজপুত্তুর কি বললেন। 

দহলানী: তিনি রেগে উঠে বললেন, সেতো ভালই। সাজের ভিতর দিয়ে রুচি দেখা দিল। তিনি বললেন, দেখে হেসোনা, হাসতে চাও তো যাও তাদের কাছে যারা তাসের সং সেজে বেড়ায়। 


তিন লাইনের মধ্যে এরম একটা হাড়হিম করা কলোনিয়াল থিসিস দুষ্প্রাপ্য। কি কি জানলাম

১/ মানুষ আর তাসেরা আলাদা, fundamentally একে অপরের সং সাজা সম্ভব, তার বেশি না। 

২/ তাসেরা মানুষের সং হওয়া ভালো, তাতে রুচি দেখা দেয়। 

৩/ মানুষরা তাসের সং হলে, সেটা খারাপ। এতটাই খারাপ যে তারা শুধু সেই কারণেই হাস্যস্পদ। 


অর্থাৎ তাসত্ব/মনুষ্যত্ব একইসাথে identity এবং characteristics তাসিরা যাকে রং খসিয়ে মানুষ হওয়া ভাবে, সেটা সং সাজা। তাতে মনুষ্যত্ব লাভ হয়না, রুচির বিকাশ ঘটে। মানুষ তাসের ঢং করলে, তারা তাস হয়না। আমরা তাদের তাস বলে ভুল করিনা, শুধু তাদের কুরুচি নিয়ে হাসাহাসি করতে পারি (নেটিভঘেঁষা সাহেবদের প্রতি ভিক্টোরিয়ানদের মনোভাব স্মরণীয়) এমন কি মানুষের মধ্যে যা যা খারাপ (যা আমাদের পোশায়না), তাকে তাসের কায়দা বলে চালানো যায়। 


আরো দেখার যে, মানুষ, তাস (অন্তত ভাল তাসেরা), আর আমরাও এই থিসিস সত্যি বলেই ধরি। সদাগরকে যখন রাজপুত্র শুধরে দেন, আমাদের গা রি রি করেনা। রুচি-তে কেন মানুষের একচেটিয়া অধিকার, কেনই বা তাসের ঢং মানুষের তুলনায় এত খারাপ, তাসেরা রং খসালে মানুষ না হয়ে সং হয় কেন, ইত্যাদি প্রশ্ন করিনা। এটাই কলোনিয়াল দৃষ্টি। 


/ রাজার প্রহরী ওরা 


কলোনিয়াল লেখার নাম করলেই যে লেখাগুলোর কথা ওঠে (এই ধরুন heart of darkness, kim, passage to india, ইত্যাদি) তার সবকটাই প্রায় সাহেবদের লেখা, সেখানে কলোনিয়াল প্রভুত্ব অবাধ। তাসের দেশের কবির গায়ের রং আমরা জানি। না জানলেও পরিষ্কার দেখাই যায় যে উনি রাজপুত্র-সদাগর নিয়ে মোটেও ভাবিত নন। ওই চরিত্রগুলোর কোন পরিণতি নেই। কবির মমত্ব তাস-তাসিনিদের প্রতি, তাদের মুক্তিই আসল উদ্দেশ্য। রাজপুত্ররা সহায়ক, “means to an end” কবি সাম্রাজ্যবাদী নন, সাম্রাজ্যবাদের দালাল। 


এই দালালি নিয়ে কবির হালকা একটা খটকা দেখা যায়, শুরুর দিকে। খাল কাটতে উনি রাজি, কিন্তু কুমীরের চরিত্র নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত


(নেট দেখলাম এই নিয়ে দু চারটে বই পাওয়া যায়।Colonial Literature and the Native Author: Indigeneity and Empire, Brown Romantics, সুন্দর সুন্দর নাম। খুব দামও।)


দুটো প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে গিয়ে এই খটকাটা মনে হল। রাজপুত্র কোথায় থাকে, আর কি চায়


প্রথমটা ধরুন। ভৌগোলিক সূত্র দুটো, ১/ যেখান থেকে হাঁসেরা বসন্তকালে হিমালয়ের দিকে যায়, / যেখান থেকে পশ্চিম সমুদ্রপারে হাওয়াই মার্কা ট্রপিকাল দ্বীপ পাবার আশা (স্বপ্ন) প্রথমটা ভারতবর্ষের (পূর্বদিকের?) সাথে মেলে। বসন্তে হাঁসেরা সাইবেরিয়ায় ফেরে, উত্তরপূর্ব ভারত থেকে দেখা যায়। কিন্তু তাইলে পশ্চিম দিগন্ত কই? আর যদি তাও হয়।আরও পশ্চিমে গেলে ট্রপিকাল দ্বীপই বা কই। জাপান নাকি! পূর্বদিকে গেলেই ল্যাঠা চুকত, সাগরও হত দ্বীপও হত, বাঙ্গালির বিজয়যাত্রার খানিক স্মৃতিরোমন্থনও হত। কিন্তু পশ্চিম থেকে আগ্রাসন যে নেটিভদের কেমন সুবিধের হয়, তা কবির জানা, রাজপুত্ররা কি তাই উলটোদিকে? পশ্চিমমুখী


লক্ষণীয় যে তাসের দেশটাও প্রশান্তমহাসাগরের দ্বীপ (আক্ষরিক? নাকি শান্তিপূর্ণ বোঝাতে রূপক) কিন্তু সেখানে জাহাজডুবি হয়ে পৌঁছানয় দিকনির্ণয়ের সুবিধে নেই। 


উদ্দেশ্য নিয়েও দ্বন্দ্ব। রাজপুত্র বোরড, বাণিজ্য- যাবেন। সেখান থেকে সাত রাজার ধন মানিক হাতাবেন। এই অবদি খাসা ছিল। কিন্তু কবির তাতেও মুশকিল। বনিকের মানদণ্ড যে কালে কালে কি দাঁড়ায়! তাসেদের অমন বিপদ কবি চান না। তাই আগেই বলেছেন, মানিক সে মানিক না (সদাগরি) রাজপুত্র অলক্ষ্মীকে পেতেই আগ্রহী। বরং নবীনা নিয়ে হালকা exotic sexuality 


হলে কি হবে, আসল কথা বাণিজ্য-ই। আশা একটাই, ফিরবে রাজার মত, নৌকোভরতি লুঠের মাল নিয়ে। বাকি মোটিভ স্পষ্ট হয়না।


আরেকটা মজাও বেশ। রাজপুত্রর যাত্রা শুরুসাজিয়ে নিয়ে জাহাজখানি, বসিয়ে হাজার দাঁড়ি”, কিন্তু খানিক বাদেই নিজের কল্পনায়, “আমিই শুধু একলা নেয়ে, আমার শূন্য নায় এই যে সাম্রাজ্যবাদ, একিসাথে একটা বিশাল এন্টারপ্রাইজ এবং তার বিপ্রতীপে একটা একক রোমান্টিক অভিযান, এটা খাঁটি কলোনিয়াল হিরোর ভাবনা।           


তাসের দেশ- নেমে ইস্তক রাজপুত্রের রোমান্টিক ভাবনাচিন্তা উধাও, সোজা মিশনারি।এলেম নতুন দেশে  আদিখ্যেতা শেষ হতে না হতে, সদাগর যখন তাসের চালচলন নিয়ে বিব্রত, “চৌকো চৌকো কেঠো চাল- চলেছে, বুকে পিঠে চ্যাপ্টা রাজপুত্র বললেন, “এর থেকেই বুঝবে, এটা বানানো, এটা উপর থেকে চাপানো, এদের দেশের  পণ্ডিতদের হাতে গড়া খোলস। আমরা এসেছি কি করতে - খসিয়ে দেব। ভিতর থেকে প্রাণের কাঁচা রূপ যখন বেরিয়ে পড়বে, আশ্চর্য করে দেবে।” 


ভাবুন একবার। একটা দেশে নেমেই, শুধু চালচলন দেখার ভিত্তিতে (এখনো তাসদের সাথে একটা কথাও হয়নি), তাদের রোগনির্ণয়, দোষী নির্ণয় (পণ্ডিত), নিজেকে ত্রাণকর্তা হিসাবে দেখা এবং সর্বোপরি এই ত্রাণই যে অভিযানের আসল উদ্দেশ্য তা প্রচার করা, সব একসাথে। এই যে দু মিনিট আগে বাণিজ্য, নবীনা, নাম না জানা প্রিয়া, নানান মোটিভ, সব হাপিশ। আর কি কনফিডেন্স! পণ্ডিতের তৈরি খোলসটা কুচুৎ করে কেটে একটু চ্যবনপ্রাশ লাগিয়ে দিলেই প্রাণের কাঁচা রূপ হু হা করে বেরিয়ে আসবে।  


তা তাসেদের এই রূপান্তরের (সদাগরের কথায়, বিধাতার ব্যাঙ্গ থেকে মানুষের সং-) আয়োজক রাজপুত্রের উপায়গুলো কি? সব কলোনিয়াল স্তম্ভ। অবজ্ঞা, মিথ্যে, হিংসা (violence) সাথে খানিক কূটনীতি, কুযুক্তি। 


অবজ্ঞাটা সহজেই চোখে পড়ে, তাসদের যে ঠিক সিরিয়াসলি নেওয়া যায়না। বিশেষত রাজপুত্র সদাগরের সামনে, এটা খুব স্পষ্ট। সম্পাদক কৃষ্টি কৃষ্টি বলে চেঁচালে আমরা তাকে রুচির বিকাশের মত সত্যি ভাবিনা, আজব ভাবি। চলা বসা, জামা কাপড়, সবই হাস্যকর। সদাগর তো বিধাতার ব্যাঙ্গ বলেইছেন। অবজ্ঞার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পাই রাজপুত্রের কাছেই। রাজাকে খুশি করে দিতে স্তব করছেন


“(রাজা) তাম্রকূটঘনধুম্রবিলাসী। তন্দ্রাতীরনিবাসী। সব-অবকাশ ধ্বংস। যমরাজেরই বংশ।” 


ইয়ার্কি হচ্ছে? এটা শুনে (বুঝলে) রাজা খুশি হবেন? অবশ্যই না। তবে? রাজপুত্রের ভাবনায় এটা আমাদের সাথে একটা private joke রাজার বোঝার ক্ষমতাটুকু নেই, স্তব হিসেবেই শুনছেন। এতটাই অবজ্ঞাঘন তাঁর দৃষ্টি। “Sub-altern cannot speak” এর অন্য রূপ,  “Sub-altern cannot listen/comprehend either”। 


এবার মিথ্যেটা দেখি। ব্রহ্মা হাই হয়ে (তুলে) তাস সৃষ্টি করেছেন এই থিওরি নিয়ে আমরা যাই হাসাহাসি করি, তাসেরা কিন্তু এটা সত্যি বলেই মানে, আর সেই হিসেবেই রাজপুত্রদের বলেছে। উলটোদিকে যখন তাদের উৎপত্তি নিয়ে প্রশ্ন এল, রাজপুত্র আর সদাগর কিন্তু আগাগোড়াই মিথ্যে কথা। ব্রহ্মার হাঁচির সাথে যে ওদের কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই, তা রাজপুত্রও জানেন আর আমরাও। তাসেরা মনুষ্যেতর বলেই, তাদের মিথ্যে বলা দোষের না।    


মিথ্যের পথ ধরেই হিংসার আনয়ন। রাজপুত্রদের আদি কবির (মিথ্যে) মন্ত্র চমকে দেওয়া হিংস্র। 


ভয় কি দেখাচ্ছ? ধরি টিপে টুঁটি, মুখে মারি মুঠি। বল দেখি কি আরাম পাচ্ছ?”  


নেটিভদের প্রতি আগন্তুকদের ব্যবহার ঠিক কিরম হবে, তার পূর্বাভাস স্পষ্ট। আরাম যে হবেনা বলা বাহুল্য। 


এখানে আমার শোনা আর পড়ায় খানিক তফাত আছে। রেকর্ডটায় এই মন্ত্র কানে আসে হঠাত, ফ্রয়েডিয়ান স্লিপের মত প্রকাশ পায় সাম্রাজ্যবাদের নখ-দাঁত। সদাগরের কণ্ঠ থেকে সমবেত স্বর আসে, একলা নেয়ের পিছনের হাজার দাঁড়ির আভাস দিয়ে যায়। যাতা এফেক্ট। লেখায় দেখলাম যুদ্ধ কিরম হওয়া উচিত, আগন্তুকদের কেন একটু রক্তারক্তি না হলে মন ভরে না, ইত্যাদি অনেক বেশি কথা। বক্তব্য একই, আগন্তুকরা বেশ হিংস্র।    


তাসদের মধ্যে দুটো কলোনিয়াল লক্ষণ চোখে পড়ে। প্রথমটা ভালো তাসেদের, রোমান্টিক অতীতচারিতা আর বর্তমানের প্রতি বিরাগ/লজ্জা। কপিবুক hegemony রুইতনের কথায় এই তাস জন্মটা মিথ্যে, কিন্তু তা বলে আকাশে যে (সত্যি) জন্মটা ভাসছে সেটা নতুন কিছু নয়, সেই (গৌরবময়) যুগের পুনরুদ্ধার। রেনেসাঁর ভাবনায় ওরিয়েন্টালিসমের মিশেল দিলে যা হয় আর কি। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, অসংখ্য উদাহরণ। রুইতন, হরতনীর বর্তমান জীবন সম্বন্ধে ধারনা যেমন সদাগরের assessment-এর প্রতিফলন (সদাগর বলেন তাসেরাবিধাতার ব্যঙ্গ”, হরতনী বলেনবিধাতার ধিক্কার”), কল্পনার অতীত জীবন তেমনি হুবহু রাজপুত্রদের কাজকর্মের পুনরকথন। পাহাড় ভাঙ্গা, দুর্গ জয়, জয়ধ্বজা বহন, বন্দিনী উদ্ধার, সবি রোমান্টিক অভিযান, কলোনিয়াল নকল। 


ইতরজনের চিন্তায় এর ব্যাখ্যা, “আমার বাবা গরু খায়না। বাবু গরু খায়। ব্যাদে লোকে গরু খেত। ফলত ব্যাদের কালে আমি বাবুর সমান ছিলাম। উহাই স্বর্ণযুগ। গণ্ডগোলটা বাবার।" লক্ষণীয় যে এই পুনর্নির্মানের প্রয়োজনও রাজপুত্রের ভাবনা থেকেই, বর্তমানের খোলস ছাড়িয়ে প্রাণের কাঁচা (অথচ প্রাচীন) রূপ উদ্ধ্বার।      


দ্বিতীয় লক্ষণ এক দ্বিমাত্রিক দুঃখবোধ। তাসেদের এই মানুষ হয়ে ওঠায় কি পরিমাণ চাপ হবে তা নয় আমরা ইতিহাস থেকে জানি, কিন্তু সেটা তাসেরা জানবে কি করেঅথচ দহলানী জানেন "মানুষের দুঃখ ঢের, তাসেদের বালাই নেই।তা কিসের এই দুঃখ? আমরা যে দুটো মানুষ দেখি, তার একজনের দুঃখঅভাবেরই অভাব”, অন্যজনের তাও নেই। তারা হাসছে, খেলছে, জলে ঝাঁপ দিচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।এইরম রাজকীয় দুঃখের কথাই কি দহলানী ভাবছেন? নাকি যে (রোমান্টিক) দুঃখে ইস্কাবনী, টেক্কানীর "নয়ন আপনি ভেসে যায়”? তাই বা হবে কি করে, এরা তো এখনো মানুষ হয়ে ওঠেননি। 


দুঃখটা আমাদের চেনা, যাকে বলে “white man’s burden” কলোনিয়াল ভাবনায় এই দুঃখবোধের দুটো কাজ, / শোষকের প্রতি সহানুভূতি, আমাদের ঠেঙ্গিয়ে বাবুর হাতে কত ব্যাথা কি সাম্রাজ্য সামলাতে চার্চিলের কেমন প্রেসার বাড়ছে, আর / নেটিভদের যে দুঃখ সইতে হবে তার পথ পরিষ্কার করা। দুঃখ ব্যাপারটা গৌরবময় কিনা।


(এরম খেলা এখনও মাঝেমাঝেই হয়, কদিন আগেই শুনছিলাম গ্রীসকে EU- যোগ্য হতে গেলে কীসব কৃচ্ছসাধন করতে হবে, যাতে লোকজনের ভালই চাপ হবে। EU- মেম্বারশিপ কি এমন আনন্দের বিষয়, আর তার জন্য কতটা কষ্টসাধন সহনীয়, এই নিয়ে বক্তব্যে লোকজনের তেমন হাত নেই, ওটা EU- বাবুরা ভেবে দিয়েছেন।)


কবি যে সাম্রাজ্যবাদী নন, তার আরেকটা খাসা উদাহরণ হল তাসিনিদের কথোপকথন। হরতনী, চিঁড়েতনী, টেক্কানী, দহলানী, ইস্কাবনীরা যে শুধু মনুষ্যত্ব গ্রহণের নানান স্তরে আছে তাই না, প্রায় প্রত্যেকে এই পরিবর্তন নিয়ে নানান ভাবে ভাবছেন (বলছেন) উদাহরণ দিচ্ছি না, এই জায়গাগুলো এতই উপভোগ্য যে বললে পুরোটাই বলতে হয়। কিন্তু একটু দেখলেই পোস্ট-কলোনিয়াল ভাবনার প্রায় প্রতিটি নেটিভমুখি চিন্তার (যেমন “hybridization”, “ambivalence”, “mimicry”, ইত্যাদি) উদাহরণ বা পূর্বাভাস পাওয়া যায়। এসব নিয়ে বিদ্বানদের আলোচনার বছর পঞ্চাশেক আগে। নেটিভদের এই পরিমাণ intellectual স্বীকৃতি কলোনিয়াল লেখায় বিরল, ভালো নেটিভ হলেও। এইখানে কবি দেশি। 


শেষে বলিআর পাঁচটা কলোনিয়াল অভিযানের মতই তাসের দেশের গপ্পোটা নেটিভদের জন্য ট্র্যাজিক। নিজেদের ভাষা শিক্ষা সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিয়ে নিজভূমে নির্বাসিত হবার যে কি সুখ, নেটিভ আমেরিকান কি সাউথ আফ্রিকার কালোদের ইতিহাসে ভালোই আন্দাজ হয়। কবি যাই ভাবুন, তাসেদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।  


/ গুণের মধ্যে ওই 


তাসের দেশ- যে শুধু কলোনিয়াল কি পোস্ট-কলোনিয়াল ভাবনাই পাই, তা নয় মোটেও। এই ধরুনপ্রগতি সম্বন্ধে পঞ্জার সন্দেহ, “ওরে ভাই, কি বলে এরা! এগোবে! — অম্লানমুখে বলে বসল, ‘এগোব”, উত্তর-আধুনিকতার গোড়ার প্রশ্ন। ফুকো কি স্পিভাকের মুখে বসালে কিচ্ছুটি বেমানান হবেনা। আবার হরতনীর মুখে যখন চাবুকের মত বাজে যৌনতা, “অনেকদিন তোমরা আমাদের ভুলিয়েছ পণ্ডিত। আর নয়, তোমাদের শান্তিরসে হিম হয়ে জমে গেছে আমাদের রক্ত, আর ভুলিও না।”, তসলিমার লেখা মনে হয়। রানী যখন শাস্তি (অপরাধ) আর সম্ভোগকে equate করেন, প্রতিবাদের মোড়কে হালকা যেন BDSM-এর আভাস। এরম ঢের ঢের। 


কিন্তু যে বৈশিষ্ট্যটা সবচেয়ে চোখে পড়ে সেটা আরেকটু ঘাঁটা। এক কথায় বললে, কবি উলটো কথা বলেন। ভীষণ বেশি রকম বলেন। শব্দে, ঘটনায়, বর্ণনায়, বার বার। এমনিতে ব্যাপারটা আশ্চর্য কিছু না, বিপ্রতীপের ব্যবহার আর্টের চেনা কৌশল। contrast বাড়লে দেখতে/শুনতে সুবিধে। তাসের দেশে যেমন সদাগর কি দহলা পণ্ডিত। এরা উলটো বলেন, কিন্তু তাতে সোজাটা ফুটে ওঠে। সদাগরের কথা ধরে রাজপুত্র বক্তব্য স্পষ্ট করেন, দহলা পণ্ডিতের নিয়মকানুন ভাসিয়ে দিয়ে ইচ্ছের জয় হয়। এগুলো বোঝা সোজা। 


আসল সমস্যাটা এর নীচের তলায়। পাঠকের (এক্ষেত্রে শ্রোতার) মনে কোন চিন্তার অবয়ব (hypothesis) গড়ে উঠতে না উঠতেই কবি সেটাতে কাঠি (undermine/subvert) করেন। কখনো বা কাঠিটা আগেই করে রাখেন। এত স্পষ্টভাবে করেন যে এড়ান শক্ত। আরো বিড়ম্বনা, কবি কাঠি করেই ছেড়ে দেন। প্রায় কখনোই কোন মীমাংসা করেন না। ফলত পড়তে বা শুনতে খুব unsettling লাগে। আমার ধারনায় দুটো সম্ভাবনা, / পুরোটাই আমার কষ্টকল্পনা অর্থাৎ আমি বদ্ধ পাগল, বা / এই কাঠিবাজি কবির একটা দার্শনিক স্টান্স। ভাবনা যাই হোক, কবি তার বিপ্রতীপ ভৈরবীতে একনিষ্ঠ। সব ঝুট হ্যায়।


কয়েকটা উদাহরণ দেখি। 


এই ধরুন, সদাগর বলছেন, “দেখছ ব্যাপারটা। লাল উর্দি, কালো উর্দি, উঠছে পড়ছে, শুচ্ছে বসছে, একেবারে অকারণেভারি অদ্ভুত। হা হা হা হা।রাজপুত্র তাতে তাল দিচ্ছেন, “তোমরা যা করছিলে তার অর্থ (কারণ) নেই যে আমি আপনিও ভাবছি, তাসগুলো আজব মাল, অকারণ ওঠে বসে। কিন্তু যেই একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসব কিনা ভাবছি, অমনি সন্দেহ হয়। দু পাতা আগেই না অন্য কিছু পড়েছি? হাঁসেদের চাঞ্চল্য নিয়ে রাজপুত্র বলেছেন, “বাসা যদি তবে ছেড়ে আসে কেন। না না, ওড়বার আনন্দ, অকারণ আনন্দ।এটা কিরম দাঁড়াল? অকারণ শব্দের অনুপ্রাস যেন, একবার ভালো বোঝাতে, একবার তুচ্ছার্থে। আমরা দ্বন্দ্বে, কোনটা ধরব। 


একই প্রক্রিয়া (অনুপ্রাসে কাঠিকরন) আবার দেখি, অদ্ভুত শব্দটা নিয়ে। সদাগরের মুখে অদ্ভুত তুচ্ছার্থে, হাসির উদ্রেক ঘটায়। খানিক বাদেই যখন ছক্কা বলেন, “পিতামহের নাসিকার অসংযম-বশতই তোমরা এমন অদ্ভুত।রাজপুত্র বিশেষণটা লুফে নেন। এক পলকে অদ্ভুত হয়ে ওঠে গৌরবের বিষয়, নূতন যৌবনের দূতের পরিচায়ক। একই শব্দের তিনবার ব্যবহারে তিনরকম মানে। শুধু যে শব্দ তাই না, পুরো সংলাপগুলোই এমন ভাবে সাজানো যাতে যে কোন অর্ডারে পড়া যায়। সদাগরেরহা হা হা হা পিঠে রাজপুত্রঅকারণ আনন্দ”-এর জয় গাইতে পারতেন।  হাঁসেদের দেখে সদাগরহা হা হাকরতে পারতেন। ছক্কা সদাগরের মত তাচ্ছিল্যে হেসে উঠতে পারতেন, নতুন যৌবনের গান শুনে। খুব গোলমেলে ব্যাপার। 


আপনি বলবেন, আহা করেছেন তো মীমাংসা, খানিক বাদে রাজার সাথে কথায়। তাসেরা অনর্থক কাজ করে নিয়মবশত। মানুষেরা নিয়ম মানেনা, অনর্থক কাজ করে ইচ্ছের তাড়নায়। নিয়মের ওপর ইচ্ছের জয়, মিটে গেল।  কারণ-অকারণ, অদ্ভুত-কিম্ভুত সব dependent variable, ইচ্ছাধীন হলে ভালো, নিয়ম হলে খারাপ। 


কিন্তু তাতেও কি সয়? দুভাবে কাঠি করেছেন। / রাজপুত্র বলছেন, “বেড়ার নিয়ম ভাঙলেই পথের নিয়ম আপনিই বেরিয়ে পড়ে, …” অর্থাৎ কিনা নিয়ম সেই রইলই, তফাত শুধু কোন নিয়মটা মানছেন।Illusion of free will আর কি, সত্যি না। কাঠি করা উদ্দেশ্য না হলে, দুবার নিয়ম লেখার দরকার ছিল কি? পথের আনন্দ কি মুক্তির কথা বললেই হত। যাত্রাপথের আনন্দগান তো কম গাননি। / সদাগর বলছেন, তার সকারণ খাঁচায় থাকাই ইচ্ছে, অকারণ ওড়ার চেয়ে। অর্থাৎ কেউ যদি ইচ্ছে করেই নিয়ম মানে, তার কি উপায়? নিয়ম উড়ে গেলে, সেই ইচ্ছেটার কি হবে? একই উলটো কথা আবার বলছেন গানে, “সেই তো আঘাত করছে তালায়, সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়অব্দি ঠিক ছিল, কিন্তুবাঁধন পড়তে সেই তো আবার ফিরছে”?             


আবার দেখুন। তাসেদের আদবকায়দা ওঠাবসা নিয়ে এত সমস্যা, অকারণ rituals-এর জালে জীবন ওষ্ঠাগত। এটা বারবার বলছেন, দেখাচ্ছেন। আধুনিক enlightened রাজপুত্রের হাত ধরে এই জঞ্জাল থেকে মুক্তি। আমরাও বাঁচি। যেই না ভাবলেন, মনে পরবে একটু আগে এই রাজপুত্রের মা- বলছেন, “ললাটে দেব শ্বেতচন্দনের তিলক, শ্বেত উষ্ণীষে পরাব শ্বেতকরবীর গুচ্ছ। যাই কুলদেবতার পুজো সাজাতে। সন্ধ্যার সময় আরতির কাজল পরাব চোখে। পথে দৃষ্টির বাধা যাবে কেটে।ভাবুন এবার, বাদুরে খাওয়া গাবের আঁটি কি ভুঁইকুমড়োর ডালের আচারের থেকে কিছু কম উদ্ভট? লজিকের কথা তো বাদই দিন, পথে দৃষ্টির বাধাই বা কি? কেনই বা আরতির কাজল পরালে তার ঘোড়ারডিম হবে? তার চেয়েও বড় কথা, এত পুঙ্খানুপুঙ্খ  বর্ণনা আমাদের জানানোর কি দরকার ছিল? গল্পে এর প্রয়োজন তা কি? একমাত্র কাঠি করা ছাড়া। যাতে আমাদের মনে সন্দেহ থেকেই যায়। রাজপুত্র তো কই মা কে জিজ্ঞেস করলেন না? তবে কি এসবের সত্যি অর্থ আছে? তাইলে গাবের আঁটিরই বা অর্থ নেই তা জানব কি করে? ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাধানে কবির মন নেই, ঘোঁট পাকিয়েই খুশি। 


এই অব্দি পড়ে যদি ভাবেন, আরে খেলে যা, সবকটাই তো তাস আর মানুষের তফাত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। ওই যে কলোনিয়াল লেন্স, মানুষ ভালো, তাসেরা খারাপ। অদ্ভুত মানুষ ভালো, অদ্ভুত তাস হাস্যকর। শ্বেতচন্দন হুহা, ভুঁইকুমড়ো হাহা, ইত্যাদি। কাঠি করবেন বলে করেননি, কাঠি করে এই পার্থক্যটাই বুঝিয়েছেন। 


তাইলে এবার নজর দিন তাসেদের দিকে। প্রথম থেকেই বলছেন তাসেরা প্রাচীনপন্থী। চাল আর চলনের অদ্ভুত ব্যাখ্যায় তাসেরা চাল বেছে নেয়, কারণ চাল অতিপ্রাচীন। চলন আধুনিক তাই বর্জনীয়। কিন্তু একটু পরেই দেখি, কৃষ্টি সম্বন্ধে সম্পাদক বলছে, “না মহারাজ, মিষ্টিও নয়, স্পষ্টও নয়, কিন্তু যাকে বলে নতুননবতম অবদান। এই কৃষ্টি আজ বিপন্ন।লে হালুয়া, নবতম অবদান থেকে তো তাসেদের শতহস্ত দূরে থাকার কথা, অর্বাচীন কিছুতে তাদের যে এতও অনীহা, তাইলে কৃষ্টি নিয়ে এত হ্যাংলাপনা কেন? একবারে থেমেছেন তাও না, আবার দেখি গোলাম বলছেন, “কান-মলা  আইনের নব্যভাষা। এও নবতম অবদান এটা কি ধরনের প্রাচীনপন্থা যে নবতম অবদান দেখলেই হামলে পড়তে হয়


ওই যে কোথায় একটা লিখেছেন, "তুমি চলবে কেন, চলবে নিয়ম", তবে কি তাই সত্যি? তাসেরা প্রাচীনপন্থি/স্থবির, তারা শুধু নিয়ম মানে। কিন্তু নিয়মগুলো চলমান, নব নব অবদানের সাথে নতুন হয়ে ওঠে। তাতেও মানে হয়না। অবদানটা কার, AI? কবি বলেন না। 


শেষ করব, আমার সবথেকে পছন্দের উদাহরণ দিয়ে। তাসবিপ্লবের প্রধান হোত্রী, মুখর আধুনিকা (সবচে indoctrined-, কলোনিয়াল পাঠ ধরলে), বড় হলে মমতা কি অরুন্ধতী রায় হবে, সেই হরতনীর সাথে সব থেকে প্রাচীনপন্থী, নিয়মরক্ষক, হয়ত খানিকটা diabolical, দহলা পণ্ডিতের কথোপকথন। যার শুরুতে দহলার কৃষ্টি রক্ষার ভণ্ডামির উত্তরে হরতনী তসলিমা-প্রায় নির্ভীক, সেটা এগোচ্ছে এভাবে


হরতনীঃ অনেকদিন তোমরা আমাদেরআর ভুলিও না। 

দহলাঃ সর্বনাশ! কার কাছে পেলে কথা

হরতনীঃ মনে মনে তাকেই তো ডাকছি। আকাশে শুনতে পাচ্ছি তারই গান।

দহলাঃ সর্বনাশ! আকাশে গান! এবার মজল তাসের দেশ। আর এখানে না।   


হরতনীদের যে ঠেকানো যাবেনা তা দহলা ভালোই জানেন, এখানকার পাট উঠল। কিন্তু তখনো বিপ্লবী লিডারের আকাশবাণীর উদ্দীপনায় উনি না গলা মেলাচ্ছেন (যেমন রুইতন মেলান), না হীনমন্যতায় ভুগছেন (আমি তো কই শুনতে পাচ্ছিনা), না বিশেষ একটা প্রতিবাদ করছেন। খালি যাবার আগে, একটু ভুরু তুলে অমোঘ কাঠি, “সর্বনাশ! আকাশে গান!” 


একবার শুনে ফেললে আর উপায় নেই। তাসবিপ্লবের যে ব্যাখ্যাই করুন, পিছনে চেশায়ার বিড়ালের হাসি মত ঝুলে থাকবে দহলার অবিশ্বাস।