শুভদার একটা বই পড়লাম, "মুখোমুখি," নানান সেলিব্রিটির খোশগল্প। ব্যাক কভারে লেখা, “'মুখোমুখি' এগারোজন বাঙ্গালি সুপারস্টারকে কাছ থেকে দেখার অনন্য অভিজ্ঞতা”। সে অভিজ্ঞতার কথা থাক। লাইনটায় আটকে গেলাম। বিশেষত, “সুপারস্টার" আর "কাছ থেকে দেখা”।
বয়স তো কম হল না, লোকও দেখলাম অনেক। তার মধ্যে সুপারস্টার হবার ইচ্ছে আর ক্ষমতা হাতে গোনা কজনের। শুভময় মিত্র নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম। আদ্যন্ত সুপারস্টার। যে ওকে দু মিনিট দেখেছে সেই জানে, আমি তো প্রায় ২৫ বছর দেখছি। এই দেখাটা কাছ থেকে কিনা, শক্ত প্রশ্ন। আমার ধারনায় না। তা সে কচাল সাব-টেক্সটে আসে আসুক, আপাতত দেখার গল্পই খানিক করি।১
প্রথম দেখা
২০০০ সাল। যাদবপুর ফটোগ্রাফি ক্লাব। বাৎসরিক স্যালোন হবে (বসে আঁকোর ফটোগ্রাফি অবতার) , খুব হইহই চলে দুপুরবেলা। কে ছবি দিল, কি দিল না (এত ঘ্যাম)। কে একই ছবি এই লাস্ট ২৯ টা স্যালোনে দিয়েছে। কে ছবিতে স্ট্যাম্প মেরে পাখি বসায়।এইসব নিয়ে অনন্ত পরচর্চা। আমরা শুনে পরমানন্দ। মাঝেসাঝে নামকরা লোকজন আসে, কেউ ছবি দেয়, কেউ জ্ঞান দেয়, বেশ ব্যাপার।
এরমি একদিন ঘাপ্টিদা বলল, “আজ ক্লাবে আসিস, তিনটের সময় শুভদা আসবে।”, খানিক পজ দিয়ে “দারুণ লোক, যেমন দুর্ধর্ষ ছবি তোলে, তেমনি ভাল গল্প বলে।”। ঘাপ্টিদা কম কথার মানুষ, পারতপক্ষে কাউকে পছন্দ করেনা। ওর মুখে এরম প্রশংসা রেয়ার। গেলাম।
ক্লাবে ঢুকে দেখি, উরিব্বাস, কি উত্তেজনা। সিনিয়ররা সব প্রতীক্ষায় থরথর। কানাঘুষোয় জানলাম অসংখ্য প্রাইজ পেয়েছে তদ্দিনে, নিকন ক্যানন ইউনেস্কো ললিতকলা। PAB বলে কোলকাতার নামি ফটোগ্রাফি ক্লাবে ওর দাপটে বাঘে-গরুতে এক ডার্করুম।
খানিক বাদে এলো। মাঝারি হাইট, মাঝারি চেহারা, ধবধবে ফরসা। যদ্দুর মনে পড়ে তখন ওর একটা কাত্তিকমার্কা গোঁফ ছিল। বাদামি সার্ট, ঝুলিয়ে পরা। কাঁধে একটা ঝোলা। বাঁদিকে হালকা কান্নিক। দেখতে খাসা। তাবলে উত্তম কুমার কি সত্যজিৎ রায় নয়, যে গড়াগড়ি যাব। ভক্তির প্রথম ঢেউটা লাগল গলা শুনে। আহা! শুভদার গলায় আর বলায় এমন একটা খনখনে তাচ্ছিল্য আছে, কি আর বলি, কান জুড়নো সেই প্রথম শোনা থেকেই। ছোটবেলায় কাকু (শুভদীপের বাবা) উত্তর কোলকাতার মস্তানদের গল্প বলতেন, যারা ঠোঁট থেকে পানের কষ মুছে বেপাড়ার মস্তানদের শাসাতো, “এপাড়ায় হিং ঘাঁটতে আসিস না, গন্ধ সইতে পারবিনা।” আমার শোনায় এই ডায়ালগ শুভদার বলাতেই শোভা পায়। যাই বলুক, শুনতে অসামান্য।
গল্পও তেমনি! মিনিট পাঁচেক কীসব ছবিটবি দিল, তারপরে সব্বাই ছেঁকে ধরল, গল্প বল গল্প বল। “আরে গল্প আবার কি। সবই তো শোনা।” মার্কা বিনয়-এ কাজ হবেনা দেখে শুরু করল। যতদূর সম্ভব কিন্নর-কৈলাস বেড়ানোর গল্প।
একটা নদী-মতর ধারে ঘুরছি, টুকটাক ছবি তুলছি। একটা বাঙ্গালি গ্রুপ আশেপাশে ঘুরছে। মাঝবয়েসি একজন
অনেকখন ধরে কি একটা বলব বলব। শেষে বলেই ফেলল, “আচ্ছা আপনারা তো ফটোগ্রাফার, তাই না?” বললাম “ওই আর কি”। “একটা কথা বলুন তো, এই আপনারা যে যেখানে সেখানে রাশিরাশি ছবি তোলেন। রহস্যটা কি? ফিল্মের যা পিলে চমকানো দাম! আপনাদের দেখে তো মনেই হয়না।” বললাম, “সত্যি ফিল্মের খুব দাম, কি আর করা, আমরা ভালবাসি তাই।” লোকটা মোটে সন্তুষ্ট হল না, “না না, নিশ্চয় কিছু প্যাঁচ আছে, নইলে আমরা কি ছবি তুলতে ভালবাসিনা নাকি, তাই বলে এইরম পটাপট। বলুন না, কি করে সামলান?” যত বলি “না রে বাবা, কোনও প্যাঁচ নেই, আমরা অনেক কিনি বলে কখনোসখনো একটু সস্তায় পাই, এই অব্দি।” ও ভবি ভোলবার নয়, “এ আপনি ঠাট্টা করছেন, কিছু তো একটা আছে। শুধু ফটোগ্রাফাররাই জানে। আমরা ছাপোষা লোক তাই জিজ্ঞেস করলাম, না বললে বলবেন না”, ইত্যাদি। বেশ খানিকক্ষণ এরম চলায়, আর পারলাম না, “দেখুন আপনি এত করে বলছেন তাই বলছি, খবরদার আর কাউকে বলবেন না। ফিল্ম কোম্পানি উঠে যাবে সব নইলে।” লোকটার চোখ জ্বলজ্বলে। “এই যে দেখছেন ফিল্ম, ৩৬ টা গেট তুলে ফেললেন। এরপর কি করেন? দোকানে দিয়ে ডেভেলপ/প্রিন্ট?” “হ্যাঁ।” “ওই তো ভুল।একটু অন্ধকার জায়গা দেখে, খাপটা খুলবেন। তারপর আস্তে করে ফিল্মটা বের করে, জাস্ট উলটে নেবেন। বোঝেন না, ক্যাসেটে কি হয়। A পিঠ শেষ হলে B। ফিল্মেও তাই, উলটে নিলেই ৭২।”
লোকটা এরপর কি করল জানিনা, আমরা হেসে কেঁশে অস্থির।
প্রথমটার খেই ভাঙতে না ভাঙতে আবার গল্প শুরু। PABতে (?) ছবি দেখানোর।
সবে কিন্নর-কৈলাস ঘুরে এসেছি, বাজার গরম। একটা একটা করে ছবি পড়ছে, আর সবাই হইহই। মনে মনে একটু হিংসেও। শেষটা যেই এলো, সবাই উশখুশ। "এ আবার কি ছবি বাওয়া। ভালো বলে যা ইচ্ছে খাওয়াবে” ইত্যাদি। সবারি দীর্ঘশ্বাস, কেউ বিরক্ত, কেউ আশ্বস্ত। শুভও শেষে আলবাল ছবি তুলছে। আমি তো জানি কি হবে, একটু সময় নিয়ে বললাম, “আরে sorry, এটা ভুল বসেছে।” তারপর জাস্ট উলটে দিলাম, “আর।”
এই আর বলে একটু থেমেছে কি থামেনি, সিনিয়ররা একেবারে রে রে করে উঠল। “আরে সেই যে উলটে দিলে, উফফ।” “ওরে বাবা! সে কি যে সে উলটোনো।” ইত্যাদি। বুঝলাম এটা রিপিট গল্প, ছবিটা নিশ্চই খুব নামকরা। PAB-র লোকে কি বলল আর স্পষ্ট জানা হল না, তবে ওই “আর" থেকেই ওদের অবস্থা অনুমেয়, অনেকগুলো চেয়ার-টেয়ার উলটেছিল নির্ঘাত।
এই ছবিটা আমি দেখিনি। এখনো ভাবি মাঝেসাঝে। কি এমন ছবি যে উলটে দিলে এইরম এফেক্ট হয়? নেহাত মিরর ইমেজ, নাকি এটা প্রথম ছবিটার B সাইড, যা শুধু ফটোগ্রাফাররাই জানে।
ঘরের খেয়ে ১
প্রথম দেখার দিন কয়েকের মধ্যেই জাজিং, স্যালোন মোচ্ছবের সব থেকে উত্তেজক দিন। শয়ে শয়ে প্রিন্ট আর স্লাইড ছবি এসেছে, সব লেবেল মেরে সাজিয়ে রাখা। নামকরা ফটোগ্রাফাররা জাজ হয়ে আসেন, সাধারণত তিন জন। আমরা আলোর সামনে বা প্রোজেক্টরে ছবি ধরি, জাজেরা কাগজে নাম্বার বসান। তারপর সেসব ট্যালি করা, কে জিতল কি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।
সেবার বিচারক বেণু সেন, বিকাশ দাস, আর তুষার কান্তি (পোকা) দত্ত। প্রত্যেকেই নামকরা। প্রথম জন তো প্রাতঃস্মরণীয়। শুভদার সুপারস্টার বই-এর একটা চ্যাপ্টার এঁকে নিয়ে। দেখতে শুনতেও তেমনি। টাওয়ারিং পারসনালিটি। মাথায় লম্বাটে গম্বুজের মত টাক, সোনালি ফ্রেমের চশমা, ব্যারিটোন গলা।
এসব সেদিন প্রথম দেখা। সবই খুব আশ্চর্য, তবু সবচে যেটা মনে ধরল তা বড়দের অহৈতুকি পরিশ্রম আর আস্কারা।এই জাজদের কথাই ভাবুন। ছুটির দিন, কেউ টালিগঞ্জ কেউ দমদম ইত্যাদি থেকে এসেছেন। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা ঘুপচি চেয়ারে বসে ছবি দেখা, নাম্বার দেওয়া। মেটিরিয়াল প্রাপ্তি মাঝেসাঝে একটু চা-সিগারেট, বড়জোর এক প্যাকেট অম্বলপ্রধান বিরিয়ানি। অথচ দিনের শেষে দেখলাম ওরা আমাদের নিয়েই চিন্তিত, আমরাই তারিফ পেলাম, মারাত্মক যে কিছু মাখাইনি তাই, ওদের পরিশ্রমটা পুরোই taken for granted। ক্লাসিক ঘরের খেয়ে বনের মোষ।
আর এই মোষ তাড়ানোর রাজা দেখলাম শুভদাকে। সেবার ও জাজ না, পার্টিসিপ্যান্ট না, ক্লাবের মেম্বার তো নয়ই। এমন কি ক্লাবের সিনিয়াররা, যারা ছবি দিয়েছে, প্রাইজ-টাইজ পাবে আশা, তারাও সন্ধের দিকে আসে। শুভদা কিন্তু শুরুর থেকে। সমস্ত কাজে। কিভাবে লাইট বসবে। কোনদিকে ফ্যান রাখলে জাজদের প্রাণ বাঁচবে অথচ ছবির বান্ডিল উড়ে যাবেনা। কোন জাজ ডানহিল খান, কে ক্লাসিক। যাই হোক, শুভদাকে জিজ্ঞেস করলেই হল। বলে তো দেবেই, বেশির ভাগ করেই দেবে।
আরো দেখলাম এই যে দুটো গ্রুপ, একদিকে দিকপাল ফটোগ্রাফাররা, আর অন্যদিকে চেংড়ার দল যারা ক্যামেরা ভালো করে ধরেই দেখিনি, শুভদা তার মাঝে ব্রিজের মত। যেই একটু ব্রেক হচ্ছে, জাজেরা চা সিগারেট খাচ্ছেন, শুভদা একটা চেয়ার জুটিয়ে পাশে, গল্পগুজবে বোঝাই যাচ্ছে এক গেলাসের ইয়ার। আবার উলটোদিকে আমরা নাম্বার দেওয়া কাগজটাগজ নিয়ে ডার্করুমে ট্যালি করতে বসলে সেখানেও শুভদাই আসল।
কাজ তো হচ্ছেই, সাথে anecdotes, পুরো কথামৃত। যেমন বেণু সেনের স্কোর করা কাগজ খুলতেই বলল, “কি? স্কেল বসিয়ে মেরে দিয়েছে তো?” খুলে দেখি প্রায় তাই। নিয়মানুযায়ী প্রতি ছবিতে ১, ৩, বা ৫ নাম্বার পড়ে। বেণু সেনের হাতে বেশির ভাগ ১, কদাচ ৫, ৩ নেই। ফলে স্কোরকার্ডে একটা লম্বা লাইন। স্কেল মেরে জাজিং!
আবার TKD-র স্কোরকার্ড এলে শুভদার বক্তব্য, "ওটা পরে দেখো! আগে অন্যদেরটা।” খানিক বাদে বুঝলাম ব্যাপারটা কি! TKD ভালো মানুষ। ছবি ফোকাস হলেই ৩ দেন, ভালো লাগলে ৫। ফলে বাকিদের স্কোরটা দেখে নিয়ে, TKD-র সাথে মিলিয়ে নিলেই হয়।আলাদা করে গুনতে হয়না, অনেকটা সময় বাঁচে। শুভদার এই পর্যবেক্ষনের ধাক্কায় TKD-র স্কোরিং সম্বন্ধে আমরা এতই সন্দিহান হয়ে পড়লাম যে ওকে আর ক্লাবের জাজিং-এ প্রায় ডাকাই হল না। নেহাত ভালো মানুষ বলে ভদ্রলোক অনেক বাজে খাটনির থেকে অব্যাহতি পেলেন।
ঘরের খেয়ে ২
বেগার খাটা কাকে বলে তার চূড়ান্ত উদাহরণ দেখলাম পরের বছর। ২০০১ সাল। যাদবপুর কর্তৃপক্ষ জানালো যে ফটোগ্রাফি ক্লাবকে নতুন বিল্ডিং-এ ট্রান্সফার করা হবে। মাস ৬ নোটিশ। এই নিয়ে নানান আলোচনার মাঝে সম্ভবত অভিষেকদা (তখন ক্লাবের সেক্রেটারি) বলল, “নতুন বিল্ডিং-এর শুরুটা একটা exhibition দিয়ে করলে কেমন হয়।” ভালো কথা, কিন্তু স্যালোন তো গতবছরই হল, এবার তবে কি? একটা কন্টেস্ট করলে হয়? থিম থাকবে, ক্যাশ প্রাইজ। স্যালোনঘেঁষা, কিন্তু একই নয়।
এই অব্দি ভেবেই, "ডাকো শুভদাকে।"
প্রস্তাবটা কানে যেতেই শুভদা যে কি পরিমাণ খেপে উঠলো তা বলে বোঝানো অসম্ভব, বরং কি কি করল একটা লিস্ট দি। কন্টেস্টের নাম দিল শুভদা। থিম ঠিক করল শুভদা। ছাত্রবিভাগের প্রাইজের পয়সা, শুভদা। বাকি পয়সা পাব কোথায়? কোডাকের সাথে যোগাযোগ থেকে চেক হাতে আসা অব্দি সবই শুভদা। জাজ কারা হবেন, ফ্রেম কোথায় কেনা হবে, আলোর প্যানেল কোথায় বসবে, কি অর্ডারে সাজানো হবে, শুভদা। স্লাইডশো-এর সাথে ভাষ্যপাঠের স্ক্রিপ্ট শুভদা। রেকর্ডিং কোথায় হবে, শুভদার বাড়িতে। অশেষ।
আরো মারাত্মক যেটা করল তা হল আমাদের তাতানো। একদম শুরুর দিকে, যখন কিছুরই প্রায় ঠিক নেই, শুভদা বলল যে “দেখ, এটা ক্লাবের প্রথম কন্টেস্ট, নতুন বিল্ডিং-এর প্রথম exhibition। ভালো ছবি দেখাতে হবে, নইলে কিন্তু মান থাকবেনা।” আমরা অথই জলে। স্যালোন ইত্যাদির অভিজ্ঞতায় আমাদের কাজ ঢের লোককে চিঠি পাঠানোর, তারপর ছবি আসে, জাজেরা ভালো ছবি বাছেন ইত্যাদি, কিন্তু ভালো ছবি আসছে কিনা তা মোটেও আমাদের হাতে না। তখনও দিনকাল এত গ্লোবাল হয়নি যে পাড়ার বসে আঁকো-তে পিকাসোর ছবি পড়বে। তার ওপর প্রতিবার exhibition হয় আকাদেমি বা অন্য নামকরা গ্যালারিতে, এবার হবে তখনো না তৈরি হওয়া ক্লাবঘরে। ক্যাশ প্রাইজ ভাবা হচ্ছে বটে, তবে সেটা কোত্থেকে আসবে আর এলেই বা কত টাকা হবে, কারুর কোনও ধারনাই নেই।
শুভদা নির্বিকার, “আরে চেষ্টা করতে হবে। কাছাকাছিতে যারা আছেন তাদের গিয়ে বল যে এটা প্রথমবার করছ। ক্লাবের প্রেস্টিজের ব্যাপার।” আমরা সন্দিহান, এত প্রতিবারই বলা হয়। বিশেষত কোলকাতার যারা নামকরা তাদের। খুব যে লাভ হয়, তা না। ওরা exhibition-এ আসেন, জাজিং করেন। খুব ঝোলাঝুলি করলে, অগত্যা বলে একআধটা ঝরতিপড়তি ছবি দেন। স্বাভাবিক, পাড়ার সরস্বতী পুজোয় সন্ধ্যা মুখার্জিকে গাইতে ডাকলে যেমন হত আর কি। শুভদার সাথেই এইরমটা বেশ কবার হয়েছে।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি দেবে?” শুভদা, “অবশ্য।” “কি ছবি?” “দেখার মত।”
ব্যাস, ওতেই হল। দ্বিফলা ক্যাম্পেন। প্রথমে TKD কে ধরা হল। TKD ক্লাবের প্রায় ঘরের লোক, সবেতেই থাকেন, উৎসাহ দেন। তা বলে ছবি দেবার কথা হয়নি কখনো। এবার আমরা নাছোড়বান্দা। প্রথমে খানিক ক্লাবের প্রথম কন্টেস্ট ইত্যাদি ঘ্যানঘ্যান করেই ব্রহ্মাস্ত্র, "শুভদা কিন্তু ছবি দিচ্ছে। শুধু দিচ্ছে না, দেখার মত ছবি দেবে বলেছে, এমতবস্থায় আপনি না দিলে, বা তেমন ভালো না দিলে … ।" TKD রাজি হলেন।
এরপর মেমারি গেমের মত নাম বাড়তে শুরু হল। শিবনাথদাকে (বসু) গিয়ে বলা হল, এই দেখুন শুভদা দিচ্ছে, TKD দিচ্ছেন, সুতরাং। ধীমানদা, অনিরুদ্ধ রায় (নামধাম একটু ভুল বলতে পারি, চাপ নেবেন না), সন্তোষ রাজঘরিয়া, মহাদেবদা থেকে শুরু করে ভূদেব ভগত, কে জি মাহেশ্বরী। এক বেণু সেন ধরা দিলেন না, বাকি প্রায় সব্বাই।
ব্যাপারটা যে মন্দ দাঁড়ায়নি, টের পেলাম জাজিং-এর দিন। নাম্বার দেবেন কি, জাজেরা নস্টালজিয়ায় হাবুডুবু। “এ ছবি তোমরা পেলে কোথায়? এত শেষবার ৬২ সালে দেখা। তুষারদার (TKD) মাস্টারপিস।” বা “আরে এত শুভর ছবি, বাপ রে, এসবও জুটিয়েছ।” শেষবেলায়, বাছাই ছবিগুলো দেখে জাজেরা যেই একটু সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, শুভদার প্ররোচনা অনুযায়ী আমরা দাঁত কেলিয়ে বললাম, এবার তবে আপনারাও দিন, সবার ছবি থাকবে জাজদের থাকবে না, একি হয়। দিতেই হল।
ক্লাবের নতুন ঘরে, চুনকামের গন্ধে, অযত্নে বসানো প্যানেলে সস্তা লাইট লাগিয়ে খাসা exhibition হল। বেশি কেউ দেখতে আসেনি, তা হোক। সেই যে শুরু, এখনো ক্লাবে কন্টেস্ট হয়, অনেক বড় করে। এবার বারোতম এডিশন। আর প্রতিবার ইমেল কি ফেসবুকে খবর পেলে, মনে পড়ে আমাদের বেগার খাটার রাজাকে। অক্ষয় লেগাসি।
ব্যক্তিগত
শুভদাকে ২৫ বছর দেখার গল্প করতে গিয়ে প্রথম বছরেই আটকে গেছি, বুড়ো হলে যা হয় আর কি, বড্ড বেশি কথা মনে পড়ে। যাই হোক, এরপরে কিভাবে শুভদার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকল আর ২৫ বছরের শিষ্যত্বে ওর অনন্য প্রতিভার বিকাশ কিরম দেখলাম ইত্যাদি বললেই মানানসই হত, কিন্তু আদপে এরম কিছু ঘটেনি। আমরা বরাবর নিরাপদ দূরত্বে। কারণ মূলত তিনটে, এক আমি আজন্ম পেছনপাকা ২।, এক বিন্দু ভক্তি-শ্রদ্ধা নেই। দুই অকথ্য খারাপ ছবি তুলি, বুঝি আরো কম। ফলে শুভদার সাধনার সেরা দিকটায় অনধিকার। আর তিন (আমার ধারনায়) শুভদাও উচ্চ-মধ্যবিত্ত সার্কেলে যত স্বচ্ছন্দ, বেহালা-আমতলার ভুঁইফোড়দের সাথে তত না। আজকালকার ভাষায়, ভাইবটা মেলেনা।
কারণ যাই হোক, প্রশ্ন হল তাইলে লিখতে বসা কেন বাপু। উত্তরে বেশ করেছি বললেই হয়, কিন্তু আরও একটা কথা আছে। এই যে এদ্দিন ধরে খানিক দূরে দূরে ঘুরছি, তাতে প্রাপ্তির কোন অভাব হয়নি। শুভদা অকৃপণ। উপহার পেয়েছি, বেনারসি বিড়ির বান্ডিল থেকে সন্দীপনের ডাইরি। আশকারা পেয়েছি, “ছবি তোলা চলছে তো?” আন্তরিক উপদেশ, “শুকনো নেশাটা কমাও।” চলতে ফিরতে হামেশাই ও কি কি সব ছবি দেখতে পায় শুনে আঁতকে উঠেছি। তোলা ছবি, আঁকা ছবি, আলপনা, লেখা, রান্না, অনেক দিকে ভালো লাগা। কিন্তু সবচে বেশি যেটা পেয়েছি তা হল গল্পসুখ, গল্প শোনার আনন্দ।
ডেলিভারির কথা আগেই বলেছি, ফর্মের দিক দিয়ে শুভদার গল্পগুলো ওয়েস্টার্ন সিনেমা। খাঁটি ওয়েস্টার্ন আর্কিটাইপে যেমন অন্যান্য চরিত্র, সমস্যা, বা প্রতিপক্ষের প্রয়োজন মূলত প্রপ হিসেবে, পরিবেশের অংশ কি হিরোর আগমনী, শুভদার গল্পেও তেমনি। আর সেইমতই সমাধান, গোয়েন্দা গল্পের মত ইনিয়েবিনিয়ে একশো পাতার প্যাঁচ না, মাঠে নেমেই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই … , ফাস্টেস্ট গান ইন দ্য ওয়েস্ট। ৩।
ওর গল্পের আরেকটা গৌণ বৈশিষ্ট্য হল আশ্চর্যের প্রতি আসক্তি। কাউবয়ের সাথে গোটা দুই এলিয়েন, খানিকটা সত্যজিৎ ঘেঁষা ফ্যান্টাস্টিক।
শুভদার অনন্যতা চরিত্রচিত্রণে।
প্রথম যে গল্পটা শুনেছিলাম তার কথাই ভাবুন। যে লোকটা একটু সস্তায় ছবি তুলতে চান। আমরা তার ব্যাপারে কিচ্ছুই জানিনা প্রায়, তবু ওর মধ্যেই একটা ছবি ফোটে। লোকটা শার্ট পরে না টিশার্ট, জিনস না টেরিকটের প্যান্ট, পায়ে কি ধরনের জুতো, মাঙ্কিক্যাপ বা জলের বোতল আছে কিনা। আত্মীয়-প্রতিবেশীর সাথে এসেছে নাকি ট্রেক ক্লাব। এই যে প্রায় কিছু না বলে দু একটা আভাসে চরিত্রগঠন, অদ্ভুত দক্ষতা। ফ্যান্টাস্টিকের ছোঁওয়াটা শেষ বেলায়, ফিল্মের দুপিঠে ছবি।
এখন ভাবতে বসে এইসব চরিত্রগুলোই ভিড় করে আসছে। যেমন একজন, শুভদার কোন বন্ধুর বাবা সম্ভবত। গ্রামাফোনে গান শুনছিলেন, দেশি ক্লাসিকাল। শুভদা যেতেই প্রশ্ন, "কে গাইছে?" অবশ্যই প্রশ্নটা শুভদার কমন পড়ে যায়, অনায়াসেই বলে দেয় যে, "এ তো সালাম-নাজাকতের জুটি।" না পড়াটাই অস্বাভাবিক হত, ক্লিন্ট ইস্টউডের বন্দুক জ্যামের মত। আসল গল্প কিন্তু লোকটার। দু লাইনের রোল। তাতেই কি খায়, কি পরে (কি পড়ে), কি শোনে, কোথায় থাকে, হীনমন্যতায় ভোগে না নস্টালজিয়ায়, বেশ ধরা যায়।এই লোকটা যে কিছুতেই ওই সস্তার ছবি তুলতে চাওয়া ভদ্রলোকের খুড়ো-জ্যাঠা নন, এতো বলাই যায়।
আরেকজন পাহাড়ি ড্রাইভার, গভীর ঝড়জলের রাতে যার নার্ভ ফেল করে, আর চালিয়ে উঠতে পারেনা। শুভদাদের সে রাতে ফেরা খুব জরুরি, আর যাত্রীদের মধ্যে সবথেকে ঘাগু ড্রাইভার, যিনি সারা সন্ধে আস্ফালন করেছেন, কাজের বেলায় ঠিক পিঠটান দেন। অগত্যা শুভদাকেই চালিয়ে ফিরতে হয়। ও ভীষণ ভালো ড্রাইভ করে, ফলে কোন চাপই হয়না। এই আস্ফালক ভদ্রলোকও বেশ চরিত্র, তাও, মন পড়ে থাকে ড্রাইভারে। টাকার দাবি, কাপুরুষতার লজ্জা, মায় কড়া রামের ঢোঁক, কিছুই যাকে সে রাতে ভরসা দেয়না। যে হার মেনে নেয়।
আরেকজন যাকে খুব মনে পড়ে, তিনি সাইকিয়াট্রিস্ট (বা সাইকলজিস্ট)। শুভদাকে কেউ হয়ত জোর করেই তার কাছে পাঠিয়েছিল (বাবা? ঠিক মনে নেই)। শুভদার ব্যাপারটা পোশায়নি তেমন। সেটা গল্প না। গল্প হল যে এই মহিলা, শুভদার পাগলামি ঠিক করবেন কি, ওর প্রেমে পড়ে গেলেন। এরপর শুভদার বাবা নির্ঘাত হাল ছেড়ে দেন, গল্প শেষ। কিন্তু ওই একটা লাইন যে কত কিছু বলা (অবশ্যই শুভদার ডেলিভারিতে)। আর সুপারস্টার শুভদার বিপ্রতীপে মহিলার চরিত্রায়নের ধাপগুলো? এ খনি ব্যাপার, লেখা যায়না, অরসিকে বুঝবেনা।
শুভদা শতায়ু হোন।
------
পুনশ্চ
আশ্চর্যের ব্যাপারটা গৌণ হলেও দিব্বি মজার। দুটো কারেন্ট উদাহরণ, এইবারের বইমেলায় শোনা। কার একটা জলসা শোনার অভিজ্ঞতার গল্পে, কিষান মহারাজ একটা অনুষ্ঠানে তবলা বাজাচ্ছেন, পাশে একটা রিভলভার রাখা। এটাই গল্প। এই রিভলভারের আশ্চর্যটা শুভদার বলায় আর বাঁহাতের বন্দুক মুদ্রায় যা ফোটে। আহা।
আরেকটা গল্পে, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ছেলে (বা ভাইপো), শুভদার বন্ধু, সে শুভদাকে, “একটা জিনিস দেখাব” বলে ঘরে ডাকার পর, “আরিব্বাস! দেখি একটা মলোটভ ককটেল! বুঝলে কেসটা!”
আমার বোঝার কোন সম্ভাবনাই নেই, কিন্তু দেখতে শুনতে হাজারবার রাজি।
শুভদা শতায়ু হোন।
---------------------
১। শুভময়দাকে কাছের লোকজন হয় শুভময় নইলে শুভদা ডাকে। শুভদা বলেই লিখব বাকিটা। দুটো অক্ষর বাঁচবে। কিন্তু আমার মাথায় ও চিরকাল শুভময়দা। এরম একটা অসাধারন ঘাগু লোককে যে (মনে মনে) “শুভ ময়দা” ডাকা যায়, এই অসভ্যতাটা ভীষণ টেম্পটিং (যতিবিলাসীরা ক্ষমা করবেন)। মুখে ডাকলে “ভ" টা প্রায় উহ্য থাকে, হাসি পায়না।
২। শুভদা এর একটা ভালো বাংলা করেছে, একে বলে “উগ্র মনন”।
৩। বলা বাহুল্য আড্ডার চুটকি গল্পে লোকে পুতুল নাচের ইতিকথা বলবেনা।লেখার সময় শুভদা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যরকম, অনেক গভীর আর আন্তরিক। এই জন্যেই ওর লেখা আমার তেমন পোষায় না। কি আর করা, কাউকে টলস্তয় টানে, কাউকে হানি সিং।